আমাদের বাড়ীটি ইউনিভার্সিটি শহর থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরে, এই ইউনিভার্সিটিতে প্রতি বছরই এপার বাংলা-ওপার বাংলা মিলিয়ে বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রী পিএইচডি করতে আসে, পিএইচডি কমপ্লীট হয়ে গেলেই ওরা চাকুরী নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। বর্তমানে এখানে ৩৫ থেকে ৪০ জন বাঙ্গালী ছেলেমেয়ে আছে। ওদের সকলের সাথে আমাদের বেশ হৃদ্যতা আছে। ওরা আমাদের কাছে সন্তানের মত, আমাকে কেউবা ডাকে কাকীমা/আন্টি, কেউবা ডাকে বৌদি/ভাবী। এই ক’জন বাঙ্গালী নিয়েই আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশ, বিভিন্ন উপলক্ষে সকলে একত্রে মিলিত হই, সেখানে আড্ডা, গান-কৌতুক এবং খাওয়া-দাওয়া সবই চলে, কয়েক ঘন্টা একসাথে হই হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেই। যেহেতু ওদের আন্টি, তাই বছরে দুই তিনবার ওদের সবাইকে বাড়ীতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতাম। কিন্তু মা মারা যাওয়ার কারণেই কিনা জানিনা, আমার বাড়ীতে গত দুই বছরে আর কোন আনন্দানুষ্ঠান করিনি।
গত বছর শেষ হয়ে আসতেই ভাবলাম, অনেকদিন পার হয়ে গেছে, আমার ঘরে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান হয়না। কেমন যেন চারদিক শুনশান নীরব হয়ে থাকে। হঠাৎ করেই খারাপ লাগলো, খেয়াল হলো, এই ছেলেমেয়েগুলো ওদের বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে এখানে আছে, প্রবাসে আমরাই ওদের স্বজন। আমি কি বুঝে এতদিন ওদের থেকে দূরে থাকতে পারলাম! যেই ভাবা সেই কাজ, ওদের সবাইকে আমাদের বাসায় নেমন্তন্ন করলাম। আগামীকাল দুপুর, মানে ২৭শে অক্টোবার, রবিবার দুপুরে ওরা আমাদের বাসায় লাঞ্চ করবে।
এক বছর পর আন্টির কাছ থেকে নেমন্তন্ন পেয়ে, সকলেই প্রশ্ন করেছে, “ আন্টি, কি উপলক্ষ”? আমি তো কোন উত্তর খুঁজে পাইনা, বলি, “ কোন উপলক্ষ নেই, অনেকদিন তোমাদের জন্য রাঁধিনি, সেটিই উপলক্ষ।
আমার মা ছিলেন জীবন্ত কম্পিউটার, পঞ্চাশ বছরের পুরানো টাকা পয়সার হিসেব, দেনা-পাওনার হিসেব, বাড়িভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিলের হিসেব থেকে শুরু করে পরিচিত (বিখ্যাত-অবিখ্যাত) সকলের জন্ম তারিখ, বিয়ের তারিখ, বিবাহ বিচ্ছেদের তারিখ, মৃত্যু তারিখ সঠিকভাবে বলে দিতে পারতেন। স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন, উনার সহকর্মীরাও কোন হিসেব জানতে হলেই ‘শংকরীদিদি’র শরণাপন্ন হতেন।
মায়ের কাছেই জেনেছিলাম, আমার বাবার জন্ম হয়েছিল কার্তিক মাসে, কার্তিক মাসে জন্ম হলে নাকি ‘মরা কার্তিকে’ জন্ম বলা হয়। কেন ‘মরা কার্তিক’ বলে, এর কারণও নিশ্চয়ই বলেছিল, আমি ভুলে গেছি। আমার বাবার জীবনটা তো খুব দুঃখ- সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কেটেছে, সেই প্রসঙ্গেই বোধ হয় বলেছিল, ‘মরা কার্তিকের শিশু’। বাবার মা, অর্থাৎ আমাদের ঠাকুমা বলেছিল, বাবার জন্ম হয়েছে ১৩৩৪ সালের ৯ই কার্তিক। আমার কম্পিউটার মা হিসেব করে বলেছে ১৯২৭ সনের অক্টোবার মাসের ২৬, ২৭ অথবা ২৮য়ের মধ্যে যে কোন একটি তারিখ।
আমাদের নিজেদের জন্মদিনে একজন আরেকজনকে ‘হ্যাপী উইশ’ করার রেওয়াজ আমিই চালু করেছিলাম। তেমন তো কিছু নয়, শুধু ফোন করে বলা, “ হ্যাপী বার্থডে”। আমার এই রীতি মায়ের খুব মনে ধরেছিল। যার যখন জন্মদিন, মা অপেক্ষা করতো, আমার ফোনের। যদি কখনও একটু দেরী হয়ে যেত, মা পাল্টা ফোন করে মনে করিয়ে দিত জন্মদিনের কথা। এমনও হয়েছে, কোন কারনে আমি মা’কে ফোন করেছি, লাইন কেটে দেয়ার আগেই আমাকে মনে করিয়ে দিত পনের দিন পরে কারো জন্মদিনের কথা।
গত সপ্তাহে আমার কি কারণে যেন মনে হলো, বাবার জন্মদিন ২০শে অক্টোবার। আমি যথারীতি ১৯শে অক্টোবার দেশে ফোন করে ছোট ভাইকে বললাম, “ কাল বাবার জন্মদিন, বাবাকে হ্যাপী বার্থডে বলিস”।
ভাই বলল, “ বাবার জন্মদিন ৯ই কার্তিক, আজ তো ১লা কার্তিক”।
আমি বললাম, “ওহ! আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, ২০শে অক্টোবার বাবার জন্মদিন”।
ভাই বলল, “অসুবিধা নাই, বাবার জন্মদিন যদি ২০ তারিখেও হয়ে থাকে, তাহলে এই এক সপ্তাহ বাবাকে পুরাদমে ফিস্ট খাওয়াচ্ছি, গতকাল থেকে ফিস্টি শুরু করে দিয়েছি।”।
আমি হেসে ফেলি, জানতে চাই, ঘটনা কি?
ভাই বলে, “ বাবা একদিন ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল, মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল খাবে, খাসীর মাংস দিয়ে পরোটা খাবে। খাসীর মাংস দিইয়ে ফিস্টি সপ্তাহ শুরু করলাম, গতকাল বাবা খেলো খাসীর মাংস আর পরোটা, আজ খেয়েছে মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল”।
মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল আবার ক্যামনে খায়? বাবার সাথে কথা বললাম, বাবাও দেখি বলে, মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল খেয়েছে। খাসীর মাংসটা নাকি এতই ভাল ছিল যে আঙ্গুলে ধরতে গেলেই মাখনের মত গলে যায়। খাওয়ার সময় নাকি আমাদের কথা মনে পড়ছিল আর খারাপ লাগছিল। এত ভাল মাংস আমাদের ফেলে খেতে পারছিলনা।
বাবার কথা শুনে চোখ ফেটে জল আসতে চাইলো, বাবা বাইরে থেকে সিংহ, ভেতরে তালের শাঁস, স্নেহরসে টইটুম্বুর। একবার আমার সারা শরীরে অ্যালার্জীতে ঘা হয়ে গেছিল, ডার্মাটোলজিস্ট অনেক খাবার খেতে নিষেধ করেছেন তার মধ্যে ইলিশ আর চিংড়ি ছিল। ইলিশ এবং চিংড়ি, দুইই আমার খুব প্রিয়, ডাক্তারের নিষেধ শুনে মন খারাপ হলেও কিছু করার ছিলনা। সেই থেকে আমি সুস্থ হয়ে না উঠা পর্যন্ত, বাবার নির্দেশে আমাদের বাসায় একটানা পাঁচ বছর, যতদিন আমি চিংড়ি খাওয়া শুরু করিনি, চিংড়ি আর ইলিশ কেনা হয়নি। আমি পটল খেতে ভালোবাসি বলে হোস্টেল থেকে বাসায় এলেই বাবা বাজার থেকে পটল আনতে বলতো, মা’কে বলতো আমার জন্য ‘আলু পটলের রসা’ রান্না করতে। কাজেই সেই একই মানুষ, এখনও আমি তাঁর সেই মেয়ে, আর বাবাও আমার সেই বাবা, খাসীর মাংস খেতে গিয়ে মন খারাপ লাগতেই পারে। তার উপর মা বেঁচে নেই, মায়ের ভূমিকাও বাবাকেই পালন করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলাম, “মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল আবার ক্যামনে খায়”!
বাবা বলল, “ জীবনে তো খাস নাই, তাই বুঝস না। মালপোয়া হবে কম মিস্টি আর বুটের ডাল হবে ঝাল ঝাল স্বাদে। খেয়ে দেখিস, নিজেও খাবি, জামাই বাবাজী আর বাচ্চাদেরকেও খেতে দিবি”।
বললাম, “ না বাবা, মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল খাবনা”।
অপেক্ষায় থাকি ৯ই কার্তিকের, আমার বুড়ো বাবার জন্মদিনের, যে বাবাকে ছোটবেলায় কেউ ‘শুভ জন্মদিন’ বলে চামচে করে পায়েস তুলে খাওয়ায়নি, যে বাবাটার জীবন ক্ষয়ে গেছে আমাদেরকে মানুষ বানাতে গিয়ে, সেই বাবাটার জন্মদিনে খালি মুখে একটু ‘হ্যাপী বার্থডে’ বলবো, সেই সুযোগটাও যেন হাত ফসকে বেরিয়ে না যায়।
গতকাল ছিল ২৫শে অক্টোবার, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শুনেছি বেগম জিয়া তিন দিন হরতাল ডেকেছেন, অশান্তি মন নিয়ে বাবাকে ফোন করেছি। বাবা বাথরুমে ছিলেন, ফোন ধরেছে আমার ছোট ভাই। বললাম, “ বাবার জন্মদিন কবে রে”?
ভাই বলল, ‘ আগামীকাল’।
ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করতে না করতেই বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ফোন ধরলো। বাবার সাথে দেশ নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। আমার বাবা অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন, দেশ সচেতন, উদার, বিবেকবান একজন মানুষ। ভাগ্য বিড়ম্বণার কারণেই বাবা আজ এমন সাধারণ এক জীবন যাপন করে গেলেন। নাহলে আমার বাবাও হয়তো সমাজে প্রতিষ্ঠিত কোন ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারতেন।
‘মরা কার্তিকে’ জন্মালেও বাবা জন্মেছিলেন বাড়ীর প্রথম পুত্র সন্তান হয়ে। সারা বাড়ীতে প্রথম পুত্র, আনন্দই আলাদা। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন নারায়ণগঞ্জ কোর্টের মোহরার, ঠাকুমা ছিলেন কোচবিহারের ধনী পরিবারের মেয়ে। যে কালে বরের বংশ পরিচয় কন্যা সম্প্রদানের প্রধান বিচার্য্য বিষয় হয়ে থাকে, সে কালেই ঠাকুমার বিয়ে হয়েছিল সাধারণ এক মোহরারের সাথে। অতি সাধারণ মানের জীবন-যাপন করছিলেন ঠাকুমা। বাবার বয়স যখন মাত্র তের, ঠাকুরদাদা মারা গেলেন, আর্থিক অসচ্ছলতা আর চারপাশের স্বজনের অবহেলার কাল শুরু হলো। লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম, বাবা দিনের বেলা স্কুলে যেতেন, রাতের বেলায় কুপির আলোয় বিড়ি বানাতেন। একেক বান্ডিল বিড়ি, মাত্র চার পয়সা দরে বিক্রী হতো। এই গল্প শোনাতে গিয়েই বাবা বলেছিল, বিড়ি পাকাতে পাকাতেই বিড়ি খাওয়া শুরু করেছিলাম।
১৯৪২-৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় বাবা ক্লাস নাইনে পড়ে। চারদিকে কী অভাব, আমাদের বাড়ীতে সদস্য সংখ্যাও ছিল অনেক বেশী, চরম অভাবে কারো জন্য কারো দরদ ছিলনা, একান্নবর্তী পরিবারে প্রত্যেকে তার নিজের সন্তানের বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবতো, আমার বাবার মাথার উপর রোজগেরে কেউ ছিলনা, বাবার তখন বাড়ন্ত বয়স, ছোট দুই ভাই, সকালে পায়ে হেঁটে চার মাইল দূরের স্কুলে যেত, পকেটে থাকতো বুট ভাজা, বিধমা মা এইটুকুই যোগাড় করতে পারতো। একমুঠ বুটভাজা আর স্কুলের ‘চাপকল’এর জল খেয়ে সারাদিন পার করে বিকেলে বাড়ী ফিরে আসতো। সন্ধ্যায় ছোট থেকে বড়, সকলেই বাটি মাপা পাতলা জলের মত খিচুড়ী খেতে পেত। ঐ মন্বন্তরে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছিল। বাবার এক কাকাত ভাই, খুব ছোট, একটু ভাতের জন্য কাঁদতো, আরেক কাকার আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল, তাই তার বাচ্চার জন্য এক মুঠ চালের ভাত রান্না করা হতো, দুঃখী মা তার ভাত পাগল বাচ্চার জন্য ঐ সুখী মায়ের কাছ থেকে ভাতের মাড় চেয়ে নিত, শিশুকে খাওয়াতো, শেষ পর্যন্ত শিশুটি মারা যায়। এমনই নিষ্ঠুর, নির্দয় হয়ে উঠেছিল মানুষ।
এই গল্প আমি খুব বেশী শুনিনি, বাবার মুখে তো শুনিইনি, মায়ের কাছে শুনেছি। মা শুনেছিল আমার ঠাকুমার কাছে। আমি যখনই বাবার কথা ভাবি, তখনই বাবার কৈশোরের কষ্টকর দিনগুলোর কথা ভেবে কেঁদে ফেলি। আমারই বাবা, অথচ কি কষ্টের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছে। বিধবা মা আর ছোট দুই ভাইয়ের কথা ভেবে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করে চাকুরীতে ঢুকে গেছে। ট্রেনের ওভারশিয়ারের চাকুরী, স্কুলে মাস্টারীর চাকুরীতে পোষাতোনা। বুদ্ধি করে শর্টহ্যান্ড রাইটিং আর টাইপিং শিখে ফেলে দ্রুততার সাথে। পাট কোম্পাণীতে চাকুরী পেয়ে যায়, খুব ভাল ইংলিশ জানতো বলে ইংরেজ সাহেব বাবাকে পছন্দ করতো।
বাবার বড় মামা ছিলেন কোচবিহারে, এমবিবিএস ডাক্তার, খুব নামকরা, বিশাল ধনী, ইচ্ছে করলেই ভাগ্নেকে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শিখাতে পারতেন। উনার ইচ্ছেয় কোন ফাঁকী ছিলনা, কিন্তু উনার স্ত্রী আমার বাবাকে দিয়ে মাঠে রাখালের কাজ করাতো, বাড়ীতে সংসারের কাজ করাতো, লেখাপড়ার কোন সুযোগ রাখেনি। মামীর বিরুদ্ধে কোন নালিশ না করে দুই বছর পর বাবা গ্রামের বাড়ীতে ফিরে আসে, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মা তাঁর ছেলেকে আর কখনও বড় ভাইয়ের কাছে পাঠাননি।
যে মানুষটি নিজের জীবনে মাতৃস্নেহ বাদে আর কোন স্নেহ পাননি, যে মানুষটির ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল, যে মানুষটি ডাক্তার মামার কাছে থেকে লেখা পড়া করতে চেয়েছিল, সেটি উনার জীবনে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই, নিজের জীবনে সে সকল অনাস্বাদিত আকাংক্ষা পূর্ণ করেছিলেন ভাগিনা, খুড়তুতো বোনদের নিজের কাছে রেখে বড় করে। আমার পিসীমার দুই ছেলে, খুব ছোটবেলাতেই আমার বাবার কাছে থেকে যায়। একজন ম্যাট্রিক, ইন্টার -মিডিয়েট পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে, ইউনিভার্সিটিতে অনার্স মাস্টার্স ফার্স্টক্লাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে্র ডাকসাঁইটে প্রফেসার হিসেবে রিটায়ার করেন।আরেক ভাগিনাও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করেন, বাবার বোনেরা বিয়ের পর এখন যার যার সংসা্রে ভালই আছে। বাবা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, নারীর মুক্তিতে বিশ্বাস করেন। প্রতিটি মেয়ের জীবনে লেখাপড়াকেই প্রধান শক্তি মনে করেন।
বিয়ের সময় মা ক্লাস নাইনে পড়তেন, বিয়ের পর মায়ের লেখাপড়া বন্ধ হতে দেননি। পাশ করার পরেও মা’কে ঘরে বসে থাকতে দেননি। মা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরীতে যোগদান করেন এবং বাবার সাহচর্য্য পেয়ে একটানা ৪২ বছর শিক্ষকতা শেষে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। আমরা তিন ভাই, এক বোন বাবার নিজহাতে গড়া। নিজহাতে বলতে যতটুকু বুঝা যায়, তার চেয়েও অনেক বেশী শ্রম ও স্নেহ দিয়ে বাবা আমাদের বড় করেছেন। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিলনা, কিন্তু সুখ ছিল। বাবা, মা, চার সন্তানের সুখের সংসার। নিজের সংসারে, নিজ সন্তানদের গড়ে-পিটে বড় করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি, অবাক হয়ে ভাবি, আমার বাবা কি করে আমাদের সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার করিয়ে এনেছেন, একজনও বাদ যায়নি। নিজের ভাই বোন, আমার মায়ের ভাই-বোন, পাড়া প্রতিবেশীর ছেলেমেয়ে সকলকেই অনেক সহযোগীতা করেছেন, আজ আমরা সকলেই যার যার জীবন সততা ও নিষ্ঠার সাথে যাপন করে যাচ্ছি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা নিজেদের জীবনে কাজে লাগাচ্ছি।
সেই যে সততার ভেতর দিয়ে বাবা জীবন শুরু করেছিলেন, সততার গন্ডীর ভেতরেই নিজেকে আটকে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে আজন্ম বিশ্বাস, বিশ্বাসে এখনও অটল আছেন, ভালোই তো আছেন, এই ৮৬ বছর বয়সে পৌঁছেও এখনও যুবকের মত দৃপ্ত ভঙ্গী নিয়ে কথা বলেন। উনাকে দেখে একটি উপমাই মনে হতে পারে, বটবৃক্ষ এবং জ্ঞাণবৃক্ষ। আজ একটি বিষয় ভেবে অবাক হচ্ছি, আজ পর্যন্ত জানিনা আমার বাবার চোখ দুটো দেখতে কেমন! এর আগে কোনদিন মনেও হয়নি আমার বাবা দেখতে কেমন, ভাল করে একটু তাকিয়ে দেখি তো। চোখের প্রতি আমার আজন্ম দূর্বলতা অথচ কোনদিন মনে হয়নি আমার বাবার চোখ দুটি দেখতে কেমন? মনে হয়নি এসব কিছুই, বাবাকে শুধু বাবা বলেই জেনেছি। বাবা তো বাবা, বাবা এমনই হয়, বাবাকে আবার আলাদা আলাদা নাক চোখ দিয়ে বিচার করতে হয় নাকি? পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বাবাদের নাক মুখ চোখ সবই সুন্দর হয়, সব সুন্দর মিলে মিশে একাকার হয়ে সৃষ্টি হয় ‘বাবা’।
আগামীকাল আমাদের বাড়ীতে এতগুলো ছেলেমেয়ে আসবে, আজ সারাদিন আমি রান্না করেছি, রাতে বাবাকে কল দিলাম, বার্থ ডে উইশ করার জন্য। মায়া লাগে, কি বিষন্ন কন্ঠ, সঙ্গীহীন জীবনে একাকীত্ব ভর করতে চায়। দুষ্টুমী করে ইংলিশে বলেছিলাম, হ্যাপী এইটি সিক্সথ বার্থডে মাই ড্যাড। বাবা থতমত খেয়ে বলে, হু আর ইউ স্পিকিং প্লীজ? আমি হেসে ফেলি, বাবাও হেসে ফেলে, নিজের ভুল বুঝতে পারে। আজ আর রাজনীতি নিয়ে কথা বলিনি।
বাবা বলল, “ আমার জন্মদিন উপলক্ষে তোরা মন খুলে খাওয়া দাওয়া কর, আমি তোদের নামে এখানে বিল পাস করে দিচ্ছি”।
বললাম, “ বাবা, জানো একটা মজার ঘটনা বলি, কাকতালীয় ঘটনা, তোমার জন্মদিনের তারিখ মাথায় ছিলনা, বেশ কিছুদিন আগেই এখানকার বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের আমাদের বাসায় নেমন্তন্ন করেছি, আগামীকাল ওরা আসবে। নেমন্তন্ন যখন করেছিলাম, সকলেই জানতে চেয়েছিল, উপলক্ষ কি? উপলক্ষ বলতে পারিনি, আমি তো জানতামওনা, ঈশ্বর এত বড় উপলক্ষ আমার জন্য সাজিয়ে রেখেছেন, আগামীকাল খাওয়া-দাওয়ার শেষে ওদেরকে বলবো, “ আজ ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজনের জন্মদিন”। কেউ না কেউ জানতে চাইবে, শ্রেষ্ঠ বাবার নাম কি? তখন বলবো, শ্রেষ্ঠ বাবাটি হচ্ছেন আমার বাবা, বাবার নাম ‘সুনীল আকাশ’, আজ আমার বাবার জন্মদিন”।
বাবা বলে, এই পাগল মাইয়া, এভাবে কান্দিস কেন? তোদের কান্না কি আমি এখন সামলাইতে পারি? বুড়া হইছিনা? আগে তো তোর মা পাশে ছিল, একভাবে কেটে গেছে জীবন, এখন আমাকে একা সামলাইতে হয়, তোর যদি এভাবে কান্দিস, আমি সামলাই কি করে?
-বাবা, আমার বাবা, তুমি তো এখন শুধু বাবা নও, তুমি তো আমাদের মাও, পারতে হবে বাবা, তোমাকে বাঁচতে হবে, আমাদের জন্য, তুমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই, তুমি যদি হারিয়ে যাও, আমাদের মাথার উপর আর সুনীল আকাশটা থাকবেনা, তোমার ‘সুনীল’ নামটা যিনি রেখেছিলেন, তিনি তোমার মাঝে আকাশের বিশালতা দেখেছিলেন, তাই তোমার নাম রেখেছিলেন ‘সুনীল’, শুভ জন্মদিন বাবা, তুমি শতায়ু হও, প্লীজ!